‘ডামি নির্বাচন’ প্রতিহত করে লুন্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার এখনই সময়: তারেক রহমান

0
787

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৭ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের জন্য দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সরকারকে অসহযোগিতা করার কথা বলেন।

দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে দেওয়া ওই ভাষণে তারেক রহমান বলেন, আপনারা আগামী ৭ জানুয়ারীর ‘ডামি নির্বাচন’ বর্জন করুন। ‘নির্বাচনের নামে’ ৭ জানুয়ারি’র ‘বানর খেলার আসরে অংশ নেবেন না। আপনারা কেউ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। এটি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন ৭ জানুয়ারি কাকে এমপি ঘোষণা করবে গণভবনে সেই তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। সুতরাং, ৭ জানুয়ারির ‘ডামি নির্বাচনে’ ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ দায়িত্ব পালনে বিরত থাকুন।

দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত রাখুন। ব্যাংকগুলো এই অবৈধ সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম। সুতরা, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কিনা সেটি ভাবুন। মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মী আপনারা আজ থেকে আদালতে মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের প্রতি সুবিচার করার আদালতের স্বাধীনতা ফ্যাসিবাদী সরকার কেড়ে নিয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েছে বলে উল্লেখ করে বিএনপির দেশান্তরি এই নেতা বলেন, সাম্য-মানবিক মর্যাদা-সামাজিক সুবিচার মুক্তিযুদ্ধের এইসব মূলমন্ত্র হারিয়ে দেশে এখন সর্বত্রই পাহাড়সম বৈষম্য-অমানবিকতা-আর অবিচার-অনাচার। একজন মাত্র ব্যক্তির অবৈধ ক্ষমতার লালসা মেটাতে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায়। সামাজিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চরিত্র নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এবার সর্বশেষে পরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করে দেয়া হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে বিনাভোটে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে দুর্নীতিগ্রস্ত বণিক, আমলা, পুলিশ এবং ক্ষমতাসিন দলের সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মাফিয়া চক্র। এই মাফিয়া চক্র দেশে এখন দুর্নীতি আর লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে। দুর্নীতিবাজ লুটেরা চক্রকে প্রতিহত করে জনগণের রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার এখনই চূড়ান্ত সময়।

রাজনীতির পাশাপাশি ভাষণে দেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, সরকারের দুর্নীতি অনাচারের কারণে দেশে বর্তমানে কৃষক শ্রমিক দিনমজুর, স্বল্প আয়ের মানুষ লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত। দুর্নীতিবাজদের উল্লাস নৃত্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধবিত্তসহ সকল মজলুমের হাহাকার-আর্তনাদ। দেশের কৃষকগণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, অথচ প্রতিদিন বেড়েই চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। মানুষ চাল কিনলে ডাল আর ডাল কিনলে চাল কেনার টাকা থাকে না। ডিম কিনলে পেঁয়াজ আবার আবার পেঁয়াজ কিনলে কাঁচামরিচ কেনার টাকা শেষ। এভাবে দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে অর্ধাহারে-অনাহারে রেখেই উন্নয়নের নামে চলছে বলগাহীন দুর্নীতি। তাই আপামর জনগণের স্বার্থবিরোধী এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে প্রতিহত করে শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠার এখনই চূড়ান্ত সময়।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজার, ব্যাংক বীমাসহ দেশের অর্থকরী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দেউলিয়া। ডলারের অভাবে এলসি খোলা যাচ্ছে না। ডলারের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত পড়তে যেতে পারছে না। দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমান ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অপরদিকে খেলাপি কিংবা মন্দ ঋণের কবলে পড়ে দেশের ব্যাংকগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা পরিশ্রম করে দেশে কোটি কোটি ডলার পাঠায় আর আওয়ামী দুর্নীতিবাজরা সেইসব বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার করে দেয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায়।

তিনি বলেন, গত একযুগে দেশ থেকে পাচার করে দেয়া হয়েছে ১১ লক্ষ কোটি টাকা। আওয়ামী দুর্নীতিবাজ চক্র দেশের টাকা বিদেশে পাচার পাচার করে কানাডায় গড়ে তুলেছে বেগম পাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকন্ড হোম। ইউরোপ, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে গড়ে তুলছে বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ি- নিরাপদ আশ্রয়। টাকাপাচারকারীদের কবল থেকে দেশ উদ্ধার করে দেশের ব্যাংকবীমাসহ অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ করার এখনই সময়।

বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের বিবরণ তারেক রহমান ভাষণে তুলে ধরেন। তিনি সরকারকে ফ্যাসিবাদী উল্লেখ করে বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে যাতে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে, সেজন্য বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে সীমাহীন অত্যাচার-মিথ্যাচার। বছরের পর বছর ধরে একদিকে খুন, গুম, অপহরণ, গুপ্তহত্যা চলছে; অপরদিকে লক্ষ লক্ষ মিথ্যা মামলা দিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। গত ১৫ বছরে শুধু সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় দেড়লক্ষ রাজনৈতিকউদ্দেশ্য প্রনোদিত মামলায় ৫০ লক্ষ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। প্রায় তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার। ৭০০ মানুষকে গুম করা হয়েছে। খুন করা হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। কেড়ে নেয়া হয়েছে ভিন্ন দল ও মতের মানুষের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। জনগণের জন্য একটি নিরাপদ মানবিক বাংলাদেশ গড়তে ক্ষমতালোভী রক্তপিপাসু ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়।

তিনি ভাষণে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেন বলেন, দুদক এখন ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবাজদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বিডিআর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যেভাবে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়া হয়েছে। একইভাবে একজন প্রধান বিচারপতিকে অস্ত্রের মুখে দেশ থেকে বের করে দেয়ার পর সম্পূর্ণভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কবর রচিত হয়েছে। এরপর আর কোনো রাখঢাক না রেখেই বিচারবিভাগ এখন প্রকাশ্যেই ফ্যাসিবাদের দোসর। ক্ষমতাসীনদের অপকর্মের বিরুদ্ধে জবাব দেয়ার বৈধ হাতিয়ার ছিল জনগণের ভোটাধিকার। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে জনগণের সেই অধিকারকেও কেড়ে নেয়া হয়েছে।

মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আবারো ঘনিয়ে এসেছে জাতীয় নির্বাচন। বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তি এবং দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে জনগণের প্রত্যাশিত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অথচ সরকার জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচনের পরিবর্তে ‘ডামি রাজনৈতিক’ দল দিয়ে ‘ডামি নির্বাচনে’র আয়োজন করেছে। এই ‘ডামি নির্বাচনে’ বানরের পিঠা ভাগের মতো নিজেদের মধ্যে পার্লামেন্টারি আসন ভাগাভাগি করেছে। এখন ‘বানর খেলা’র আসরের মতো লোক জমানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রায় ২০০০ কোটি টাকা তসরুপ করে নিজ দলেরই একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে ‘ডামি প্রার্থী’ বানিয়ে নির্বাচনী আমেজ তৈরির অপচেষ্টা চলছে। সুতরাং, ‘ডামি নির্বাচন’ প্রতিহত করে ১২কোটি ভোটারের লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার এখনই সময়।

২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের নির্বাচন সরাসরি সংবিধানের ৬৫ এর ২, ১১, ৭ এর ক এবং ১৪৮ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, বর্তমান সরকার সম্পূর্ণভাবে অবৈধ, অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক। এই অবৈধ সরকারের কোনো আদেশই প্রশাসন মানতে বাধ্য নয়। একইভাবে জনগণও অবৈধ সরকারকে সহযোগিতা করতে বাধ্য নয়। এমনকি অবৈধ এই গণবিরোধী সরকারকে জনগণ ট্যাক্স দিতেও বাধ্য নয়।

এ ছাড়া তিনি বলেন, এই অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতা করতে গিয়ে প্রশাসন কিংবা দেশপ্রেমিক জনগণ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার অবশ্যই সকল ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আপনাদের ত্যাগের প্রতি সুবিচার করবে। একইসঙ্গে আমি আরো বলতে চাই, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের যারাই হতাহত হয়েছেন, ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক সরকার তাদের অবদানও দলীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করবে।

জনাব তারেক রহমান তার ভাষণে ১৯৭১ সালে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়ে তুলে ধরে বলেন, আজকের আন্দোলন, দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন। চলমান এই আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতায় পৌঁছাতে দলীয় পরিচয়ের উর্ধে উঠে দল-মত-ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গণতন্ত্রকামী প্রতি মানুষকে বর্তমান অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতা শুরু করুন। অপরকে অসহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করুন।

এই আন্দোলনে বিজয় লাভ করেই দেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here