মঙ্গল প্রদীপ, শিখা চিরন্তন জ্বালিয়ে বাংলাদেশ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে!

0
5

মঙ্গল একটা গ্রহের নাম। রোমানরা মঙ্গল গ্রহকে যুদ্ধের দেবতা মনে করে। বৃটিশ যাদুঘরে গেলে মঙ্গলের যে মূর্তি দেখা যায় সেটি বর্শা এবং ঢাল হাতে রণসাজে সজ্জিত। গ্রীকরা মনে করে জিউস এবং হেরার পুত্র এরেস অর্থাৎ মঙ্গল হচ্ছেন রক্তাক্ততা এবং হিংসাত্মক যুদ্ধের দেবতা।

শাক্ত হিন্দুদের কাছেও মঙ্গল একজন যুদ্ধের দেবতা। তারা মনে করে ‘মঙ্গলা’ নামের দেবতা হলেন হিন্দুদের মঙ্গল গ্রহের দেবতা। এই ‘মঙ্গলা’, আবার (ভৌমা) অর্থাৎ পৃথিবী এবং শিবের রক্তবিন্দু থেকে সৃষ্টি। ‘মঙ্গলা’ দেবতা শুভ সূচনার পাশাপাশি যুদ্ধের সংগেও জড়িত দেবতা।

ইদানিং ‘মঙ্গলা আরাধনা’ অর্থাৎ মঙ্গল কালচার বাংলাদেশ জুড়ে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। তথাকথিত স্বাধীনতা নামক পড়শী অপসংস্কৃতির জালে আটকে পড়বার পর থেকে বাংলাদেশের ৯৩% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটাতে নানান শাখাপ্রশাখায় মঙ্গল আরাধনা ছড়িয়ে পড়েছে। কোন কিছুর শুভ উদ্বোধন করা হোক, বা কারও জন্মদিন, মৃত্যুদিন, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে করা হচ্ছে। দেশের হার্ট নামে পরিচিত রমনা পার্কের বুকের উপর জ্বলছে মঙ্গল ‘শিখা চিরন্তন’। দেশের গর্ব সেনানিবাসের ভিতর কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন স্থানে জ্বালানো হয়েছে মঙ্গল শিখার আদলে “শিখা অনির্বাণ”। ছেয়ে মেয়েরা মঙ্গল সূত্র নামে হাতে লাল সূতা বেঁধে স্টাইল করছে। এসবই করা হচ্ছে বাঙালী সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে।

আল কোরানের সুরাতুল যুমারের (৩৯-৩) আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট ভাবে মুসলমানদের বলছেন-‘জেনে রাখ অবিমিশ্র আনুগত্যই আল্লাহর প্রাপ্য। যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবক রূপে গ্রহন করে, এবং বলে, আমরা তো এজন্য এদের এবাদত করি যে, আমরা মনে করি এরা আমাদের আল্লার সান্নিধ্যে এনে দেবেন। যারা মতভেদ করছে, বাস্তবিকই আল্লাহ তাদের ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাদের হিদায়াত দেন না’।

অংশীবাদ কে আল্লাাহ তায়ালা আল কোরানের আরও অন্তত ২৫টি সুরাতে শিরক্ এবং অপবিত্র জ্ঞানে পরিত্যাগ করতে বলেছেন। অংশীবাদ আল্লাহর জন্য অসম্মানজনক। অংশীবাদিদের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা আল কোরানে বারবার উচ্চারিত হয়েছে।

বাংলাদেশে ৯৩% এ্যবসল্যুট মেজরিটি গোষ্ঠী মুসলমানের বাস। তারা কি কোনদিন ভেবে দেখেছে যে, এই সব মঙ্গল শিখা কালচারের সূত্র-উৎস কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের সাথে শিখা কালচারের সম্পর্কই বা কি? তৌহিদবাদি মুসলমানরা আগুনের সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে চেতনাকে উদ্দীপ্ত বা শানিত করার প্রথা কোন আদর্শ থেকে নিয়েছে?

ভারতবর্ষে এধরনের অগ্নি চুল্লী কালচার বেশ আগে থেকেই পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত বৃটিশ সৈন্যদের স্মরণে নির্মিত দিল্লীর ‘ইন্ডিয়া গেট’ নামক মনুমেন্টটিতে এই শিখা চিরন্তন দীর্ঘদিন ধরে জ্বলছে।

দিল্লীর রাজঘাটে গান্ধীজীর সমাধি বেদীর উপর জ্বালানো আছে একই ধরনের অগ্নিশিখা। প্রতিদিন বহু মানুষ এই শিখার পাদদেশে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। নীরবে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থেকে দেশের জন্য, গান্ধীজীর জন্য প্রার্থনা করেন। এছাড়া প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে সেতু উদ্বোধন, জাহাজ উদ্বোধন, শুভকাজ উদ্বোধন তো ভারতীয় হিন্দুদের ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রথা ও রীতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকালে সাহায্য করতে এসে ভারত তাদের ধর্মীয় অগ্নি কালচার, ডমিন্যান্ট কালচার হিসাবে আমাদের বুকের উপর জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা সেই অগ্নিকে : শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, মঙ্গল শিখা প্রভৃতি নানান উপাচারে আমাদের সংস্কৃতিতে আত্মীয়করণ করেছি। আসলে এটা অগ্নিপূজারীদের দেবাচার সংস্কৃতি। খেলা ওদের, মাঠ শুধু ভিন্ন।

বাংলাদেশের মুসলমানরা পরধর্মের প্রতি সহনশীলতা দেখাতে গিয়ে গত ৫৩ বছরে ‘শিরক্’ এর পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে। তারা বুঝতে পারছেনা কোনটা শালীন কোনটা অশালীন।

বহূদেবতায় বিশ্বাসী ভারতীয় হিন্দু ধর্মে অগ্নি কালচার তাদের ধর্মের প্রধান অংশ। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী ‘অগ্নি’ তাদের প্রত্যক্ষ দেবতারূপী ভগবান। হিন্দুদের কাছে পূজা, প্রদীপ এবং অগ্নি একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। একটা ছাড়া অন্যটা অসম্পূর্ণ, অচল এবং অর্থহীন। হিন্দু ঋগ্বেদ- সংহিতায় অগ্নিকে ২০০ সুক্তে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যা দেবরাজ ইন্দ্র ভিন্ন অন্য কাউকে দেয়া হয়নি। ঋগ্বেদে অগ্নিকে এতই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যে, ঋগ্বেদ শুরু হয়েছে অগ্নি বন্দনা দিয়ে (১/১সূক্ত) শেষ হয়েছে অগ্নি বন্দনার মাধ্যমে (১০/১৯১ সূক্ত)। হিন্দুদের কাছে অগ্নি এমন এক দেবতা, যিনি পার্থিব দেবতাদের মধ্যে প্রধান। অগ্নিদেব স্বর্গের দেবতাকুল এবং পৃথিবীর মানবকুলের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী। অগ্নি আপন রথে বহন করে স্বর্গের দেবতাদের পৃথিবীর যজ্ঞস্থলে আনা নেয়া করেন। চালক ছাড়া মহামন্ত্রী যেমন সভায় উপস্থিত হতে পারেননা তেমনি অগ্নি সারথি ছাড়া দেবতাগণ পৃথিবীর যজ্ঞস্থলেও পৌছাতে অপারগ। যার ফলে আগুনের পরশমণি ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা পার্বণ, যাগযজ্ঞ, জন্ম বিবাহ,মৃত্যু কোন ধর্মাচারী সাধিত হবার নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন “আগুনের পরশমণি জ্বালাও প্রাণে/এজীবন পুণ্য করো দহন দানে। আমার এই দেহখানি তুলে ধর/তোমার ঐ দেবালয়ের প্রদীপ কর।” অগ্নি হিন্দু সমাজের কাছে অনেক বড় দেবতা। কামধেনু খ্যাত বশিষ্ঠ মুনি কে ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষা দিবার জন্য অগ্নিদেবতার মুখ থেকে যে ১৫,৪০০ টি শ্লোক নির্গত হয়, সেগুলাই অগ্নিপুরাণ নামে খ্যাত। অনেক হিন্দুবাড়িতে তুলসী মঞ্চ দেখা যায় যেখানে প্রদীপ জ্বেলে সন্ধ্যা আরতি করা হয়।

এই তো ক’দিন আগে ১লা বৈশাখে ছায়ানট নামক গানের স্কুলের উদ্যোগে রমনা পার্কের অশ্বত্থ তলায় সূর্যবন্দনা করে নববর্ষ পালিত হল। এই সূর্যবন্দনা আসলে কি? সেটাও বাংলাদেশের মুসলমানরা জানেনা। হিন্দুদের সূর্য দেবতা ও তাঁর স্ত্রী ঊষার পূজার নামই হল সূর্যবন্দনা। হিন্দুদের নিকট এই পূজা ‘ছট পূজা’ নামেও পরিচিত। এই ছটপূজো নিয়ে গীতায় অনেক কেচ্ছা-কাহিনী আছে। আসল কথা হল, রমনা পার্কের অশ্বত্থ তলার সূর্যবন্দনা ছটপূজোর মতই সূর্য দেবতার কাছে শক্তি ভিক্ষার আরাধনা!

নববর্ষে ঐ একই দিনে সূর্যবন্দনা শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয় জাতীয় উৎসব নামে “মঙ্গল শোভাযাত্রা ও মেলা”। সেই শোভাযাত্রায় চারুকলার ছেলেমেয়েদের তৈরী নানান জীব জন্তুর মূর্তি ও মুখোশ পরা ছেলেমেয়েদের অংশ নিতে দেখা যায়। যার মধ্যে আছে পেঁচা, বাঘ, সিংহ, ময়ূর, ইঁদুর, ষাঁড় হাঁস প্রজাপতি ইত্যাদি। Cultural Dominance বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাংলাদেশের মুসলমানদের কিভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে সেটাই একটু দেখার চেষ্টা করি!

মুসলমানদের এধরনের মঙ্গল শোভাযাত্রা তো আল্লাহ, রাসূল(সঃ), মসজিদ, কলেমা ইত্যাদি নিয়েই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু চারুকলার ছেলেমেয়ের মাথায় সে চিন্তা এলোনা! চিন্তা এল কী?

১) পেঁচার প্রতিকৃতি! কারন হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী ‘পেঁচা’ হচ্ছে ধন সম্পদ ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর বাহন। সুতরাং পেঁচা লক্ষ্মী লাভ ঘটাবে, অর্থাৎ দেশের ব্যাংকগুলো টাকা পয়সায় ভরে দেবে! যা সরাসরি শিরক্ ই চিন্তা প্রসূত!

২) বাঘ সিংহ! হিন্দু মতে বাঘ সিংহ হল দেবী দুর্গার বাহন! হিন্দুরা দেবী দুর্গার সাথে বাঘ সিংহেরও পূজা করে! হিন্দুরা মনে করে সিংহ রাজশক্তির প্রতীক! সিংহ পাশবিকতা দূর করতে দেবী দুর্গার সাহায্যকারী। সুতরাং সিংহ প্রতীক দেশ থেকে গুম খুন ডাকাতি, শতছাত্রী সম্ভোগ উৎসব, নাথন বম তৈরির মত কারখানা ইত্যাদির বিনাশ করতে সাহায্য করবে!

একই ভাবে, ৩) ময়ূর! দুর্গার ছেলে কার্তিকের বাহন! ৪) হাঁস! হিন্দু মতে হাঁস বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন! হাঁস নিয়ে মিছিল করলে নাকি মূর্খ কাউকে পাওয়া যাবেনা। ৫) সূর্য! আগেই বলেছি সূর্যকে হিন্দুরা দেবতা মনে করে। তারা বলে সূর্য ই একমাত্র দেবতা যাকে আমরা প্রত্যক্ষ করি। উক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা আরও সেসব মূর্তির সমাবেশ ঘটায় তার সবগুলোই হিন্দু দেবদেবীর সংগে সংশ্লিষ্ট, যেমন ৬) ষাঁড় : শিবের বাহন। ষাঁড় শক্তি, আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। ৭) ইঁদুর : হচ্ছে মা দুর্গার ছেলে হস্তিমুখ গণেশের বাহন। এই প্রাণীটি দেখতে ছোট হলেও একটু একটু করে পর্বতও সাফ করে দিতে পারে সেইজন্য ইঁদুর অধ্যবসায়ের প্রতীক। এরকম আরও আছে। অযথা লেখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাইনা।

সার্বিক বিচারে এই চিন্তায় আসা যায় যে শিখা চিরন্তন, মঙ্গল শোভাযাত্রা কালচার, এবং রমনার সূর্যবন্দনার চিন্তাধারা সম্পূর্ণরূপে ইসলামি আদর্শের পরিপন্থী, পৌত্তলিক চিন্তা সঞ্জাত, এবং ভারতীয় কালচার থেকে আরোহিত পরাশ্রয়ী চিন্তাধারা! সুতরাং শিখা চিরন্তনের অগ্নিকুণ্ড যতদিন দেশের বুকে জ্বলতে থাকবে, ততদিন আল্লাহর একত্ববাদের আদর্শ খর্ব করার, আল্লাহর অসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করার অভিশপ্ত শিরকি মশাল বাংলাদেশের বুকে জ্বলতেই থাকবে।

পরিশেষে বলতে চাই, ৫৩ বৎসর আগে ধর্মনিরপেক্ষতার যে বিষ এ জাতি শরীরে গ্রহণ করেছিল তা আজ ভয়াবহ ক্যান্সার হয়ে দেখা দিয়েছে। এ কে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল করা হবে। সমালোচনার মত লো-ডোজ দাওয়াই দিয়ে এই মরণব্যাধি নিরাময় সম্ভব নয়। এর জন্য চাই কঠিন অস্ত্রোপচার। বাংলাদেশের উম্মতে মোহাম্মদীর সামনে এখন কঠিন পরীক্ষার দিন। আজ ফয়সালা হবে ৯৩% মুসলমানের দেশে ‘তওহীদ’, ‘রাব্বানিয়াত’, ‘খিলাফত-ই মোহম্মদ’ কায়েম হবে নাকি ‘মিল্লাত-ই- কুফরি’ অব্যাহত থাকবে!

লেখক:আরিফুল হক, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here