মে দিবসের নায়করা

0
11

আজ পহেলা মে। মহান মে দিবস। শ্রমিকশ্রেণির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং দীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। মে দিবসের ইতিহাস প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা প্রয়োজন, ১৮৮৬ সালের পহেলা মে শিকাগোর হে মার্কেটে কোনো রক্তপাত বা শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এদিন শিকাগো শহরের শ্রমিকরা দৈনিক কাজের সময়সীমা আট ঘণ্টা করার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয় এদিনের কর্মসূচি। দ্বিতীয় দিনেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। শ্রমিক হত্যার প্রথম ঘটনা ঘটে ৩ মে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কসে। আর পরদিন অর্থাৎ ৪ মে সংঘটিত হয় হে মার্কেট ট্র্যাজেডি। এ আন্দোলনের নেতা অগাস্ট স্পিজ ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত একজন অভিবাসী শ্রমিক এবং সাংবাদিক। কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি তিনি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত শ্রমিকশ্রেণির মুখপত্র ‘দ্য আরবেইটার-জেইতুং’-এর সম্পাদক ছিলেন। শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় প্রহসনের বিচারে অগাস্ট স্পিজ এবং তার তিন সহযোগীকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

বিশ্বব্যাপী মে দিবস : হে মার্কেট ট্র্যাজেডির দুই বছর পর ১৮৮৮ সালে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেন্ট লুইস শ্রমিক সম্মেলনে কাজের সময় আট ঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে ‘মে দিবস পালনের’ ঘোষণা দেওয়া হয়। এর এক বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর থেকে অর্থাৎ ১৮৯০ সালের ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে রাশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ১ মে সার্বজনীন শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর অনেক দেশ এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে।

আলবার্ট পার্সন: আলবার্ট পার্সন ছিলেন একজন প্রাক্তন সৈনিক। ১৮৮৩ সালে তিনি শিকাগোতে আসেন। এখানে তিনি শিকাগো ট্রিবিউনে টাইপসেটার পদে কর্মরত ছিলেন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তিনি বরখাস্ত হন। আলবার্ট পার্সন অগাস্ট স্পিজের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। হে মার্কেট স্কয়ারে অগাস্ট স্পিজের পর আলবার্ট পার্সনের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। বোমা হামলার ঘটনার পর তিনি শিকাগো শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিচার শুরুর আগে তিনি স্বেচ্ছায় ফিরে আসেন। ফাঁসিতে ঝোলানোর সময় তিনি বলেছিলেন—Let the voice of People be heard (মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাক)।

জর্জ অ্যাঙ্গেল: জর্জ অ্যাঙ্গেলের জন্ম জার্মানিতে। ১৮৮৩ সালে তিনি আমেরিকার শিকাগো শহরে বসবাস শুরু করেন। তিনি পুঁজিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা হারিয়ে তিনি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি বলেছিলেন, যে সরকার শ্রমিকশ্রেণির জন্য কিছুই করে না, শুধু বড়লোকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, সেই সরকারকে সমর্থন করা পাপ

১৮৮৬ সালের ৩ মে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কসে শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের কথা শোনার পর গ্রিফ হলে আয়োজিত বৈঠকে যোগ দেন। এ সভাকে পরে প্রসিকিউটররা ‘সোমবার রাতে ষড়যন্ত্র’ বা ‘মন ডে নাইট কন্সপিরেসি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। অ্যাঙ্গেল দাবি করেন, এটা একটি সাধারণ সভা ছিল, এতে কোনো ষড়যন্ত্র হয়নি। কিন্তু বিচারকরা তার কথা আমলে নেননি। জর্জ অ্যাঙ্গেল পরদিন সন্ধ্যায় হে মার্কেটের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন না। ওই সমাবেশে যখন বোমা বিস্ফোরণ হয় তখন তিনি বাড়িতে তাস খেলছিলেন।

অ্যাডলফ ফিশার: অ্যাডলফ ফিশারের জন্ম জার্মানিতে। ১৮৮৩ সালে তিনি শিকাগো শহরের বসবাস শুরু করেন। তিনি অগাস্ট স্পিজ সম্পাদিত শ্রমিকশ্রেণির মুখপত্র আরবেটাই জেইতুংয়ের টাইপসেটার এবং দ্য অ্যানর্কিস্ট জার্নালের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। হে মার্কেটের সমাবেশের পোস্টার মুদ্রণের তত্ত্বাবধান এবং সমাবেশে যোগদানের আহ্বানসংক্রান্ত যুক্ত করেন। ফিশার হে মার্কেটের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। তবে সমাবেশ শেষ হওয়ার আগেই তিনি অন্য সমাবেশে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে তিনি বলেছিলেন—এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত।

লুইস লিং: লুইস লিংয়ের জন্ম জার্মানিতে। ১৮৮৫ সালে তিনি শিকাগো শহরে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি শ্রমিকশ্রেণির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি শিকাগো কার্পেন্টার ইউনিয়নের একজন সংগঠক এবং কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি ছিলেন। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হওয়ার পর তিনি জেলখানায় আত্মহত্যা করেন।

মাইকেল শোয়াব: মাইকেল শোয়াবের জন্ম জার্মানিতে। ১৮৮২ সালে তিনি জার্মানিতে বসবাস শুরু করেন। তিনি বলেছিলেন, সহিংসতা এবং নৈরাজ্য এক নয়। আমরা সহিংসতার বিরুদ্ধে সহিংসতাকে সমর্থন করছি। এটা সহিংসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি উপায়। মাইকেল শোয়াব হে মার্কেটের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্য সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য চলে যান। তা সত্ত্বেও তাকে বোমা হামলার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাত বছর কারাভোগের পর ১৮৯৩ সালে গভর্নর অল্টগেল্ড তার সাজা ক্ষমা করেন।

অস্কার নেবে: অস্কার নেবের জন্ম নিউইয়র্কে। তবে বেড়ে ওঠেন জার্মানিতে। ১৮৭৫ সালে শিকাগোতে তিনি ছিলেন স্বঘোষিত কমিউনিস্ট। শিকাগোতে তিনি শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। নেবে হে মার্কেটের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন না। তবুও তাকে বোমা হামলার দায়ে দোষীসাব্যস্ত করে ১৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাত বছর কারাভোগের পর ১৮৯৩ সালে গভর্নর অল্টগেল্ড অস্কার নেবেকে ক্ষমা করেন ও মুক্তি দেন।

স্যামুয়েল ফিল্ডেন: স্যামুয়েল ফিল্ডেনের জন্ম ইংল্যান্ডে। ১৯৭১ সালে তিনি শিকাগোতে বসবাস শুরু করেন। ১৮৮৪ সালে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং পিপল অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেন। হে মার্কেটের সমাবেশে তিনি উপস্থিত ছিলেন। বোমা বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার কারণে হাঁটুতে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন ফিল্ডেন। বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ক্ষমা আবেদনের পর তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৮৯৩ সালে অল্ডগেল্ড ফিল্ডেন তাকে ক্ষমা করেন ও মুক্তি দেন।

লেখক: সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here